ভোলার ভেঁদুরিয়া-লাহারহাট ফেরিঘাটের যিনি রক্ষক তিনিই অনিয়ম আর ঘুষ বানিজ্যের মূল হোতা

অপরাধ

ঘাট ব্যবস্হাপক শিহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় থাকলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্তা বাবুরা রহস্যজনক নিরব

এম শাহীন আলম :
মালামাল বোঝাই যানবাহনের ড্রাইভার,হেলপারদের আরেক ভোগান্তির নাম ভোলা – বরিশাল নৌ পথের ভেঁদুরিয়া,লাহারহাট ফেরিঘাট। এখানে সরকারী ধার্য্য কৃত ভাড়া কয়েক গুণ বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ অহরহ। আর ফেরিতে কর্মরতদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলে চলে না রীতিমতো ফেরির ইঞ্জিন। সরকারী ধার্য্যকৃত টাকার দুই তিন গুণ বেশি দিলেই চলে ফেরি। যে সব পরিবহনের ড্রাইভার পরিবহন সংশ্লিষ্টরা ফেরিতে কর্মরতদের বাড়তি টাকা না দেন তাদেরকে ঘন্টার পর ঘন্টা অযথা বিভিন্ন অজুহাতে ঘাটেই আটকে থাকতে হয়। আর বারতি টাকা দিলেই সবার পিছনে সিরিয়ালে থাকা গাড়ীটিও অনায়াসেই পৌঁছে যায় ফেরির প্রথম সারিতে।

এই দুইটি ঘাটে প্রকাশ্য অনিয়ম ও চাঁদাবাজি চলে দিনে ২৪ ঘন্টা,সপ্তাহে ৭দিন,মাসে ৩০দিন,বছরে ৩৬৫ দিন। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে বিআইডব্লিউটিসির অসাধু ঘুষখোর কর্মকর্তা কর্মচারীদের এমন প্রকাশ্য চরম অনিয়ম চললেও সে দিকে নজর নেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বড় কর্তা বাবুদের। ফলে এই দুই ফেরিঘাটে অনিয়মই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। বারতি টাকা আদায়ের মতো অনিয়ম আর জিম্মি দশা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না পন্য বোঝাই ফেরি পারাপার কৃত একটি পরিবহনও।

সরেজমিনে অনুসন্ধানে দেখা যায় ,ভোলা থেকে বরিশালে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের কোন ব্যবস্থা না থাকায় বরিশালের লাহারহাট হয়ে ফেরি যোগে প্রায় ১৬ কিলোমিটার নদী পথ পাড়ি দিয়ে ভোলার ভেঁদুরিয়া ফেরিঘাটে পৌঁছতে হয়। সেক্ষেত্রে সময় লাগে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা। আর যে গাড়িটি সঠিক সময়ে পার হতে পারে না তাকে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হয়। অনেকেই ফেরি পার হতে না পেরে বহনকারী গাড়ি নিয়ে ফিরেও যায়। সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে বিআইডব্লিউটিসির দুই ঘাটে দায়িত্বরত ঘাট ব্যবস্হাপক শিহাব উদ্দিনের অসাধু সিন্ডিকেট। ব্যবস্হাপক শিহাবের এই সিন্ডিকেট আগে পার করে দেয়ার নামে বাড়তি টাকা নিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করারও অভিযোগ রয়েছে।

সরেজমিনে অনুসন্ধানে গেলে দেখা যায়, ভোলার ভেঁদুরিয়া ফেরিঘাটে ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় থাকা পন্য বোঝাই ট্রাক,কাভার্ডভ্যান ও মাইক্রোবাস সহ গাড়ীর দীর্ঘ লাইন। কোন কোন পরিবহন গত ২/৩দিন ধরে আটকে থাকলেও ঘাট পর্যন্ত তারা পৌঁছাতে পারেনি। কষ্ট হলেও ওইসব পরিবহনের শ্রমিকদের থাকা খাওয়া সবই হচ্ছে ফেরিঘাটের দোকান গুলোতে।

ভোলার চরফ্যাশন থেকে সুপারি ভর্তি ট্রাক নিয়ে আসা পণ্যবাহী ট্রাকের চালক মোঃ মানিক মিয়া বলেন, এই মালের গাড়ি নিয়ে বরিশাল হয়ে ঢাকায় যাবো। এজন্য গত রবিবার সকালে ভেঁদুরিয়া ফেরিঘাটে আসলাম। আজ দুইদিন হয় যেখানে এসে ট্রাক থামিয়েছি তার থেকে কিছুটা সামনে এগিয়ে আসলাম ফেরিঘাট হয়তো সন্ধ্যার আগে ফেরি আসলে যেতে পারবো কিন্ত ফেরি পারাপারে দিতে হবে সরকারি ভাড়ার চেয়ে দুই গুণ বেশি না হয় অজুহাত দেখিয়ে সহজে ফেরি ছাড়বে না।

রংপুর থেকে আসা ট্রাক চালক আবুল কাশেম বলেন, খুলনা থেকে বরিশালে আসতে রাস্তায় যে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে, মাল নামিয়ে এখন আবার ভোলা থেকে কাঁচামাল নিয়ে ফরিদপুর যাচ্ছি কিন্তু রাস্তার ভোগান্তির চেয়েও ভেঁদুরিয়া এবং লাহারহাট ফেরিঘাটে তার থেকে কয়েকগুন বেশি ভোগান্তি আর হয়রানিতে পরতে হয় এই দুই ফেরিঘাটে বিভিন্ন অজুহাতে প্রতিটি পন্য বোঝাই গাড়ি থেকে সরকারের নির্ধারিত ভাড়া দুই গুণ ভাড়া আদায়, সিরিয়ালে সামনে যেতে বারতি টাকা, ঘাট ইজারাদারদের বারতি টাকা দিতে নয়,না হয় হয়রানির শিকার হতে হয়। ট্রাক চালক আবুল কাশেম বলেন আমি গতকাল সন্ধ্যায় কাঁচামাল বোঝাই গাড়ি নিয়ে এখানে পৌঁছাই কিন্তু ফেরী ঘাট পর্যন্ত যেতে পারিনি। এজন্য ক্ষোভ প্রকাশ করে এই চালক আবুল কাশেম বলেন, আমার পড়ে এসেছে এমন কয়েকটি গাড়ীও দেখলাম ফেরি পার হয়ে গন্তব্যে চলে গেছে। কিন্তু ঘাটের লোককে বাড়তি টাকা না দেয়ায় ওভারলোডের অজুহাত দেখিয়ে আমার গাড়িটি ফেরিতে উঠতে দেয়নি এবং বারতি লোড নিয়ে কেন আসলাম তারা বারতি টাকা দাবী করে এবং বিআইডব্লিউটিসির আমার সাথে ফেরি পারাপারে দর কষাকষি করার পর বারতি টাকা নিয়ে এখন টিকিট দিয়েছে ফেরি আসলে এখন চলে যাবো ।

ভেঁদুরিয়া ফেরিঘাটে কথা হয় আরেক কভারভ্যান ড্রাইভার নাছির এর সাথে তিনি জানান, আমাদের ঘাটের টোল, ফেরি ভাড়াসহ সকল খরচ মহাজন পূর্বে থেকেই হিসাব করে দেয়। কিন্ত ঘাটে আসলে বাড়তি টাকা দিতে হয় বিআইডব্লিউটিসির লোকদের।বারতি টাকা না দিলে বিভিন্ন রকম অজুহাত দেখিয়ে গাড়ি আটক করে রাখে বিআইডব্লিউটিসির কর্তব্যরতরা।ফেরি পারাপারে সরকারি ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া অনেক সময়ে হয়রানি থেকে বাঁচতে ড্রাইভাররা নিজেদের পকেট থেকেই দিতে হয়। ভেঁদুরিয়া এবং লাহারহাট ঘাটে এমন স্বেচ্ছাচারিতা পাটুরিয়া দৌলদিয়া ফেরি ঘাটকেও হারমানায় বলে মন্তব্য করেন খুলনা থেকে এক ট্রাক চালকের সাথে আসা ব্যবসায়ী বাহাদুর।

স্হানীয় সূত্রে জানা যায়,ভেঁদুরিয়া ফেরিঘাট এবং লাহারহাট ফেরীঘাটের কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিসির টার্মিনাল সহকারীরা এবং ৪র্থ শ্রেণি কর্মচারীরা সহ দুইঘাট ব্যবস্হাপক শিহাবুদ্দীনের পোষা সিন্ডিকেটের আওতাভূক্ত স্হানীর কিছু বখাটে বহিরাগতদের দিয়ে কৌশলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়,আর অতিরিক্ত টাকা না দিলে বখাটেদের দিয়ে হুমকি দমকি মাধ্যমে মিথ্যা অজুহাত আর কৌশলে বিশেষ করে মালামাল বোঝাই গাড়ি গুলোকে সঠিক সময়ে ফেরি পারাপারে বাঁধা গ্রস্হ করার অভিযোগও রয়েছে। লাহারহাট থেকে ভেদুরীয়া পর্যন্ত এক টন থেকে ১১ টন পর্যন্ত পণ্যবাহী যানবাহনের সরকার নির্ধারিত ফেরি ভাড়া ৯২০ টাকা থেকে ১ হাজার ৮৫০ টাকা। এবং ১০ চাকার সাধারণ পরিবহনের ভাড়া সর্বোচ্চ ২৬৭০ টাকা কাগজে কলমে লিখা থাকলেও ফেরিঘাট গুলোতে কর্মরতরা প্রতি ১ থেকে ৩ টন পর্যন্ত যে কোন ট্রাকের ভাড়া আদায় করছেন ১৭৭০ টাকা সাথে আগে ফেরি পার হতে শিহাব উদ্দিন সিন্ডিকেটকে দিতে হচ্ছে এক থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত বেশি ভাড়া। এরপর ওজন বেশি হলে তো কোন কথাই নেই, ঘাটে কর্তব্যরতদের চাহিদা অনুযায়ী বাড়তি ভাড়ার বিষয়টি তো রয়েছেই নিত্যনৈমিত্তিক ব্যপার ।

ভেঁদুরিয়া এবং লাহারহাট ঘাটে শুধুমাত্র ফেরি ভাড়া নয়, ঘাটে পৌঁছতেই যানবাহন শ্রমিক ও মালিকদের পদে পদে গুনতে হয় আরো বিভিন্ন পন্থায় মোটা অংকের বিভিন্ন কৌশলে চাঁদা। এসব চাঁদাবাজদের যার কোনটির রশিদ দেয়া হয় আর কোনটির দেয়া হয় না। এর মধ্যে লাহারহাট ঘাটে ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নকে দিতে ২৭০ টাকা, ট্যাংকলড়ী শ্রমিক সংগঠনে নামে রয়েছে ৬০ টাকা, বিআইডব্লিউটিসির ঘাটের টোল সর্বনিম্ন ৫৮ টাকা এবং মসজিদের উন্নয়নের নামে আরও ২০ টাকা বাধ্যতামূলক ভাবে আদায় করা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। নামে বেনামে হওয়া চাঁদাবাজির একটি অংশ স্থানীয় প্রশাসনের পকেটেও মাসহারা হিসেবে যাচ্ছে। আর কিছু অংশ যাচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের পকেটেও।

দুই ফেরিঘাটের অনিয়ম সহ সার্বিক বিষয়ে জানতে চেয়ে ঘাট ব্যবস্হাপক শিহাব উদ্দিনকে তার মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনি রিসিভ করে হ্যালো হ্যালো বলে কল কেটে দেন এবং পরোক্ষনে কল দিলে তিনি কলটি আর রিসিভ করেননি।

উল্লেখ্য…
সরেজমিনে স্হানীয় সূত্রে মতে জানা যায়, এই ঘুষখোর শিহাব উদ্দিন গত কয়েক বছর আগেও এই দুই ফেরিঘাটের দায়িত্ব ছিলেন,তৎকালীন তিনি পন্যবাহী গাড়ীতে বিভিন্ন অজুহাতে দেখিয়ে বারতি টাকা আদায় সহ চাঁদাবাজি কালে হাতেনাতে ভোলা ডিবি পুলিশের হাতে আটক হন। আটক হওয়ার পর পুলিশের সাথে রফা করে ছাড়া পান। ঐ সময় চাঁদাবাজী করতে গিয়ে ডিবি পুলিশের হাতে আটকের বিষয়টি জানাজানি হলে বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ তাকে ঢাকা হেড অফিসে নিয়ে যায়,পরক্ষনে তাকে ক্রমানয়ে শিমুলিয়া এবং দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে দায়িত্ব দিলে সেখানেও তার বিরুদ্ধে গাড়ি সংশ্লিষ্টদের হয়রানি বিভিন্ন অজুহাতে বারতি ভাড়া আদায় সহ নানান অভিযোগ উঠলে আবারও তাকে ঢাকা হেড অফিসে নিয়ে আসে। বেশ কয়েক মাস হেড অফিসে থাকার পর বিভিন্ন ভাবে তদবির এবং অসৎ উপায়ের মাধ্যমে গত ১বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি পুনরায় ভেঁদুরিয়া ফেরিঘাট এবং লাহারহাট ফেরিঘাট বদলি হয়ে হেড অফিস থেকে এসেই মন গড়া মতো প্রকাশ্যে অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা যায়। আরো জানা যায়, গত কয়েকমাস আগেও এই শিহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে ফেরির ৫০ হাজার লিটার তেল চুরির বিষয়ে নিউজ হয়। অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে,আরো

Leave a Reply

Your email address will not be published.