মৃত্যুর মর্মব্যথা, সিত্রাং বড় স্বার্থপর

মতামত

মাসুক আলতাফ চৌধুরী :
ঘুমন্ত স্বামী-স্ত্রী- শিশু সন্তান। তুফানের রাত। টিন-কাঠের ঘর। ঝড়োবাতাসে উপড়ে পরলো বিশাল গাছ। পুরো ঘর গাছের নীচে। একেবারে খাট -বুকের ওপর। ২০০ লোক ঠেলেও সরানো যায় নি গাছ। করাত এনে গ্রামবাসীর কাটতে কাটতে পেড়িয়ে যায় ঘন্টা খানেক। হয়তো বেঁচে নেই, জেনেও চেষ্টার সবটুকুই করেছেন তারা। উদ্ধার করে হাসপাতালেও নিয়েছেন। ততক্ষণে সব শেষ। কেউ বেঁচে নেই।

স্বচ্ছলতা ফেরাতে বিদেশ করছেন অনেক বছর। গত মাসে বাড়ি আসা। দেড় মাসেরমতো ছুটি। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের স্বপ্নের পাকা দালান উঠছিল। ইটের কাজ শেষ। একতলার দু’ ইউনিট। মালয়েশিয়া ফিরে যাওয়ার আগেই- সামনের সপ্তাহে নতুন বিল্ডিংয়ে ওঠার ইচ্ছে ছিল। তুফান কেড়ে নিলো সব। পুরো পরিবার। একটা স্বপ্ন। থেমে গেল। কিছু কিছু মৃত্যু ভেতরে থেকে কাঁদায়। আপনা আপনি চোখেজল ঝড়ায়। ভুলে থাকতে চাইলেও পিড়া দেয়। মর্মপীড়া। সিত্রাং বড় স্বার্থপর। নিজের সব বুঝে নিলো।

ঘূর্ণিঝড়ের রাত। ২৪ অক্টোবর সোমবার। বিকেলেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। কালো মেঘ সন্ধ্যা নামিয়েছে অনেক আগেই। বাতাসও বইছে, ঠান্ডাও পড়ছে। গ্রামাঞ্চল। রাতও ঘনিয়েছে। ঘড়ির কাটায় আটটা হবে। বিছানায় চলে যান নেজাম উদ্দিন (২৭), স্ত্রী শারমিন আক্তার সাথী(২৩) ও পাঁচ বছরের শিশুকণ্যা নুসরাত আক্তার লিজা। দেড়-দু’ ঘন্টা পেড়িয়েছে। ঝড়ো বাতাসে পাশে পুকুড়পাড়ে থাকা কড়ই গাছিটি উপড়ে নেজামের ঘরের ওপর পড়ে। কুমিল্লা লাঙ্গলকোটের হেসাখাল ইউনিয়নের খামারপাড়া গ্রাম। রাতেই তান্ডব শেষ। পরদিন মঙ্গলবার দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন আত্মীয়-স্বজনরা। দুপুরে দাফন শেষ হয়। চির ঘুম। এখনও কান্না থামেনি গ্রামবাসীর।

পরিবার জানায়, স্বপ্নের পাকা দালানে আগামী শুক্রবারই উঠে পড়ার কথা ছিল। তাই দোয়া অনুষ্ঠানেরও আয়োজন ছিল। ছয় ভাইয়ের মধ্যে পঞ্চম নেজাম। কড়ই গাছের শিকড় অপেক্ষাকৃত দুর্বল। তারওপর গোড়া থেকে মাটি ক্ষয়ে গেলে বিপদ। পুকুর পাড়েই এ গাছ বেশি লাগানো হয়। গাছ বেশি বড় হলেও বিপদ। বিপদ হবে বলে নেজামদের কাজটিও কেটে ফেলার পরামর্শ ছিল পড়শীদের। তারাও কেটে ফেলার পারিবারিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে ছিলেন। তার আগেই যমদূত আছড়ে পড়লো।

ঝড়ে বহু গাছ উপড়ে পরে। মহাসড়ক,সড়ক,বিদ্যুতের খুৃঁটিতে গাছ পড়ে থাকে। সিত্রাংয়েও তাই হয়েছে। উদ্ধার বলতে ওই ফায়ার সার্ভিস। ঝড়ের আগে ও সময়ে জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত থাকেন তারা। তারপর গাছ, ভেঙ্গে পড়া দেওয়াল, উড়ে যাওয়া টিন- ঝাউনি সরাতে ব্যস্ত হন। সড়ক স্বাভাবিক করতে গাছ সরানোয় অগ্রাধিকার চলে। আর বিদুৎ কর্মীরা ব্যস্ত হন গাছ সরিয়ে বিদ্যুৎ লাইন জোরা লাগিয়ে বিদুৎ প্রবাহ স্বাভাবিক করতে। এবারও তাই হয়েছে। তবে কুমিল্লার ওপর দিয়ে সিত্রাং বয়ে যাবে বা যেতে পারে ঝড় শুরুর আগে এমনটা জানায় নি আবহাওয়া অধিদপ্তর। তবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ঝড়ের সামান্য আগের পূর্বাভাসে এমনটা জানায়। তবে পূর্বাভাসে ঝড়ের তীব্রতা ব্যাপক না হওয়ার আশংকা থাকায় গুরুত্বও কম মিলেছে,এটা আমাদের স্বভাবজাত। তারপরও যা ছিল পর্যাপ্ত দাবি প্রশাসনের। করেছোও তারা।

কড়ই বা শিল কড়ই বা রেনডি কড়ই। পোশাকি নাম রেইনট্রি – বৃষ্টি গাছ। চির সবুজ। প্রচুর ডাল- পালা ছড়ায়- শীতল ছায়া দেয়। খররোদে আশ্রয় – বিশ্রাম মেলায় । চির সবুজ- শোভাবর্ধনকারী। কাঠ শক্ত। ওজনে ভারী। অল্প দিনেই লক লক করে বাড়ে। বেশ উঁচু হয়। তালগাছের পর কড়ই গাছ দেখে দূর থেকে গ্রাম চেনা যায়। একসময় গ্রামে মেহগনি হতো বেশ। গত ৫০ বছরে রেইনট্রি হচ্ছে অনেক। বিদেশি গাছ। পুকুর ও গ্রামীণ সড়ক পাড়ে লাগানো হয় বেশি। ভালো খুঁটি হয়। বড়গাছ আসবাবপত্রের কাঠ দেয়। বাড়িঘর, আসবাবপত্র, নৌকা,ঘরের খুঁটিতে লাগে তাই গ্রামাঞ্চলে চাইিদাও বেশ।

গাছ জীবন বাঁচায়। সেই গাছই জীবন হরণকারী হলো। গাছ লাগালেই হবে না, যথাস্থানে লাগাতে হবে। নিরাপত্তা সবার আগে। পরিচর্যা করতে হবে। শিক্ষাটা আমাদের জন্যে।

তাদের হয়তো সবই ছিল। আবার হয়তো ঝুঁকিও ছিল। করছি,করবো ছিল। সংসারের টানা- পোড়েন, পরিবারের সবার মতামত এক হতে সময়ও লাগে। জীবন সাজাতে ব্যস্ত নেজামও পরিকল্পনায় এগোচ্ছিল। কিন্তু স্বার্থপর সিত্রাং নিজের ষোলআনা বুঝে নিল। বাঁচার তাগিদে শুইয়ে পড়া ঘুমই চিরঘুম হলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published.